ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুতে, শুধু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অঙ্গনেই নয়, বিশ্বের নানা প্রান্তেও গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন, এবং এই তার মৃত্যুর পর, এক বিশেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অধ্যাপক ইউনূস, যিনি বিশ্বব্যাপী গরীবদের জন্য মাইক্রো-ক্রেডিট সিস্টেম উদ্ভাবন করে পরিচিত, তাঁর শোক প্রকাশে ও মনমোহন সিংয়ের জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে।
মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্ব: একটি অম্লান দৃষ্টান্ত
ড. মনমোহন সিং ভারতের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি টানা দুই মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বের সময় ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উন্নতির সাক্ষী হয়েছিল। বিশেষ করে, তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে ভারতকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যান। তার শাসনামলে ভারতের অর্থনীতি উচ্চ প্রবৃদ্ধির দিকেই এগিয়ে চলে, এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় দিক ছিল তার দৃঢ় সংকল্প ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। তার সময়ে ভারত আন্তর্জাতিক মন্দার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, তিনি কীভাবে ভারতীয় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন, তা বিশ্বের অন্যতম উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া, তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত সাদামাটা, কৃতজ্ঞ এবং অল্পবয়সি-রাজনৈতিক উজ্জ্বলতার বিপরীতে এক নিরহংকারী নেতা। তার এই সাদামাটা জীবনযাপন এবং শৃঙ্খলা তাকে দেশের জনগণের মাঝে অটুট শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল।
অধ্যাপক ইউনূসের শ্রদ্ধার্ঘ্য
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি একাধারে অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মী ও নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত, মনমোহন সিংয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়ে। তিনি তার মন্তব্যে বলেন, “মনমোহন সিং ছিলেন একজন অত্যন্ত জ্ঞানী এবং সাদামাটা নেতা।” তার এই মন্তব্যে এক ধরনের ব্যক্তিত্বের প্রশংসা ছিল, যা সিংয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি। অধ্যাপক ইউনূসের কথায়, সিং শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, বরং তিনি এক ধরনের আদর্শ উপস্থাপন করতেন, যা প্রমাণ করে যে, একজন নেতার সাফল্য তার সততা ও নীতির ওপর নির্ভর করে।
মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের সম্পর্ক ছিল এক ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ, এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল। দুই অর্থনীতিবিদের আলোচনা ও মতবিনিময়ের ক্ষেত্র ছিল বৈচিত্র্যময়, এবং তারা একে অপরকে স্বীকৃতি দিতেন। এই বন্ধুত্বের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, অধ্যাপক ইউনূস বলেছিলেন, “আমরা একে অপরের পরামর্শদাতা ছিলাম, কিন্তু সিংয়ের সততা ও দক্ষতা আমার কাছে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল।”
ভারতীয় হাইকমিশনে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে গিয়ে অধ্যাপক ইউনূস মনমোহন সিংয়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং শোকবইয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। তার শোকবার্তা ছিল একটি গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য, যা শুধু সিংয়ের জীবন নয়, বরং ভারতের জন্য তার অবদানকে চিরকাল স্মরণীয় করে রাখবে। ইউনূস লিখেছেন, “মনমোহন সিং ভারতের রাজনীতির এক অধ্যায়, এবং তার পরিপূর্ণ জীবন আমাদের জন্য একটি মূল্যবান শিক্ষা।” এই শোকবার্তা ভারতীয় জনগণের জন্য একটি স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সিংয়ের জীবন ও কাজের উপর আলো ফেলবে।
মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুতে ভারতীয় শোক
মনমোহন সিংয়ের মৃত্যু ভারতীয় রাজনীতিতে এক বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। তার নেতৃত্বের সময়ে যে সংস্কারগুলো ঘটেছিল, তার ছাপ ভারতীয় অর্থনীতিতে এখনও দৃশ্যমান। ভারতের সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কংগ্রেস দলের নেতা সোনিয়া গান্ধীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা সিংয়ের অবদানের প্রশংসা করেছেন এবং তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। ভারত সরকার সিংয়ের সম্মানে সাত দিনের শোক পালন করছে, যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।
এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেও মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুতে শোকের সঙ্গেই তার নেতৃত্বের স্মৃতি চিরকাল থাকবে বলে বলা হচ্ছে। সিং তার কাজের মাধ্যমে ভারতের গরীব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনে যে পরিবর্তন এনেছেন, তা অনস্বীকার্য। তিনি ভারতের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন, এবং তার অসাধারণ নেতৃত্বের জন্য তাকে আজও মনে রাখা হবে।
মনমোহন সিংয়ের মৃত্যু আমাদের শেখায় যে, একজন নেতা কীভাবে তার দেশের জন্য অবদান রাখতে পারেন, এবং সেই অবদান কতটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের শ্রদ্ধার্ঘ্য ও শোকবার্তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, রাজনৈতিক জীবন শুধু ক্ষমতা এবং অধিকার নিয়ে নয়, বরং দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি নিয়েই সফল। সিংয়ের জীবন একটি উদাহরণ যে, কঠোর পরিশ্রম, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নৈতিকতা দিয়ে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিশাল পরিবর্তন আনা সম্ভব। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, তাকে চিরকাল স্মরণ রাখা হবে, এবং আগামী প্রজন্ম তার আদর্শ অনুসরণ করবে।